প্রায় ৪৭টি ছোট বড় নদী ও খালে সমন্বিত দেশের বৃহতম জলাভূমি চলনবিল। সিরাজগঞ্জ, নাটোর ও পাবনা জেলা জুড়ে বিস্তৃত এই বিলকে ঘিরেই গড়ে ওঠেছে অসংখ্য জনপদ। বিলের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত এমনই এক জনপদ তাড়াশ উপজেলা। রুপ বৈচিত্র আর ইতিহাস ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এই অঞ্চলের মানুষের জীবন জীবিকাও বৈচিত্রময়। মৎস্য ও কৃষি নির্ভর এ অঞ্চলের মানুষের জীবন জীবিকা। তাড়াশ উপজেলার প্রায় ৮৫ শতাংশ মানুষই কৃষি নির্ভর। প্রতি বছর তাড়াশ উপজেলা থেকে আউশ ধান প্রায় ৫৫ কোটি ৫০ লাখ, আমন ধান ২৭০ কোটি, বোর ধান ৫৪৬ কোটি, সরিষা ১৪৫ কোটি, মধু ৫ কোচি ৫০ লাখ, গম ১ কোটি ৫০ লাখ, ভুট্টা ৪৪ কোটি, রসুন ২৯ কোটি, পাট ১২ কোটি টাকার যোগান আসে এসব কৃষিপণ্য বিক্রয় থেকে। উপজেলার প্রায় ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে বছর জুড়ে চাষ করছেন বিভিন্ন ধরণের ফসল। এক সময় এই উপজেলার কৃষকরা এক ফসলের উপর নির্ভর করলেও বর্তমানে দুই থেকে তিন ফসল চাষ হচ্ছে বিল অধ্যুষিত এলাকায়। বানের পলি মাটিতে ধানের পাশাপাশি ভুট্টা, গম, সরিষা, পেয়াজ ও রসুন সহ চাষাবাদ হচ্ছে সব ধরণের ফসল। পরিণত হয়েছে জেলার খাদ্য ভান্ডারে বলে জানান, তাড়াশ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শর্মিষ্ঠা সেন গুপ্তা। তবে বিলে দেশীয় মাছের প্রাচুর্যতা কমলেও গত এক দশকে তাড়াশে বেড়েছ চাষকৃত মাছের উৎপাদন। জেলা মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, মাছ চাষ লাভজনক হওয়ায় গত ৭ বছরে তাড়াশে পুকুরের সংখ্যা বেড়ে দাড়িয়েছে ৪ হাজার ২০০ টিতে। আর এসব পুকুর থেকে বছরে উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ১১ হাজার মেট্রিকটন মাছ। চলনবিল অঞ্চলের এই মাছ কেনা-বেচা কে কেন্দ্র করে তাড়াশের মহিষলুটিতে গড়ে উঠেছে এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় মাছের বাজার। প্রতিদিন ভোর থেকে ক্রেতা বিক্রেতার হাক ডাকে মুখরিত হয়ে ওঠে এই মৎস্য আড়ত। রুই, কাতল, বোয়াল সহ সব ধরণের মাছ পাওয়া যায় এই আড়তে। প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে পাইকাররা মাছ কিনে নিয়ে যাচ্ছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। মহিষলুটি মাছের আড়তে প্রতিদিন মাছ বিক্রি হচ্ছে প্রায় ২ থেকে ৩ কোটি টাকার। বর্ষা এলেই তাড়াশ উপজেলার প্রায় ৭ হাজার জেলে পরিবারের জীবিকার প্রধান মাধ্যম হয়ে ওঠে উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছ আহরণ। দেশীয় ২৬০ প্রজাতির মাছের মধ্যে এই চলনবিলেই পাওয়া যেত প্রায় ১৬০ প্রজাতির মাছ। তবে গত কয়েকদশকে অবাধে নিষিদ্ধ জালের ব্যবহারে চলনবিল হারাচ্ছে দেশীয় মাছের প্রাচুর্যতা। দিন দিন বিলুপ্ত হচ্ছে ধোঁদা, গুড়পুঁই, বাছা, গজার, ট্যাংড়া, ভেদা, টিপপুঁটি ও পানি রুইয়ের মত ৪০ থেকে ৫০ প্রজাতির দেশীয় মাছ। যা প্রভাব ফেলছে এই এলাকার মাছের উৎপাদনে। মাছের সাথে এই উপজেলার অর্থনীতিতে বড় যোগান দিচ্ছে প্রাণিসম্পদ খাত। বিলের পানিতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে হাঁস পালন করে অনেকেই হয়েছেন স্বাবলম্বী। হাঁসের প্রাকৃতিক খাবারের অন্যতম যোগানদাতাও চলনবিল। শুধু তাড়াশ উপজেলাতেই ৯০০ বাণিজ্যিক হাঁসের খামার গড়ে উঠেছে। এসব খামারের ৪ লাখ হাঁস থেকে প্রতিদিন ২ লাখের বেশী ডিম উৎপাদন হয়। বছরে এই তাড়াশ আবারএখানকার মানুষ কৃষি আর মৎস্য নির্ভর হলেও ঋতু চক্রের সাথে সাথে বদলায় তাদের জীবন জীবিকাও। তাড়াশের কুন্দুইল এলাকায় দেখা মিললো বিচিত্র এক শামুকের বাজার। রাত ভর জাল দিয়ে নিধন করা শামুক এই হাটে নিয়ে আসেন জেলেরা। প্রতি বস্তা শামুক বিক্রি করেন ২শ থেকে ৩শ টাকায়। প্রতিদিন কয়েক টন শামুক সরবরাহ হচ্ছে খুলনা, ময়মনসিংহ, বগুড়া ও রংপুর সহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। তাড়াশ উপজেলা থেকেই বিক্রি হচ্ছে কোটি কোটি টাকার ডিম বলের জানান খামার মালিক খয়বার হোসেন। মৎস্য খাত ছাড়াও তাড়াশ উপজেলার অধিকাংশ মানুষই কৃষি নির্ভর। এক সময় বছর জুড়ে ১ ফসল চাষাবাদ হলেও বর্তমানে এই বিল অঞ্চলের চাষাবাদেও এসেছে নানা বৈচিত্র। ধান ভুট্টা আর সরিষার পাশাপাশি নানা ফসল চাষাবাদে এই তাড়াশ উপজেলা থেকেই বছরে খাদ্য ভান্ডারে যুক্ত হচ্ছে প্রায় দেড় লাখ মেট্রিকটন খাদ্য শস্য। যা অর্থনৈতিক ভাবে স্বচ্ছলতা এনে দিচ্ছে বিলাঞ্চলের মানুষদের।